সিঙ্গেল মায়ের প্রতি পরিবার ও প্রতিবেশীর প্রশ্নবাণ

সিঙ্গেল মাদার‘ শব্দটা শুনলেই মানুষ জিজ্ঞেস করে, ‘এর মানে কী?’ অর্থাৎ মা তালাকপ্রাপ্ত নাকি বিধবা তা বুঝতে অনেকেরই অনেক সময় লাগে। এখানে, অনেকে যারা বিধবা,  এখনও তাদের শ্বশুর বাড়ি নিজের বাড়ি হিসাবে বসবাস করে। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির মানুষ বিধবা নারীকে সেই বাড়ির সদস্য তো মনেই করে না, বরং স্বামী মারা যাওয়ার কারন হিসেবে, মেয়ের অশালীন চলা ফেরা, ভালো বউ না হতে পারা, অপয়া, কুলোটা, চরিত্রহীনতা, ধর্ম পালন না করা, অভিশপ্ত এসকল বিষয়কে দায়ী করে,  কেউ অপঘাতে মারা গেলে,  রোগে ভুগে মারা গেলে সেই অসহায় বউকেই দায়ী করে স্বামীর মৃত্যুর কারন হিসেবে। বউকে দিন রাত কাজের মেয়ের মতো খাটিয়ে মারে। বউ মানেই তাদের কাছে বাড়ির চাকর। আর যেসকল নারীরা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তালাকের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তো কথাই নাই। এই কারনে অনেক নারী  সমাজে ‘তালাক‘ শব্দটি বলতে দ্বিধাবোধ করেন ।

 

আবার অনেক নারীকে যৌতুকের দাবি মিটাতে না পারলে জোর করে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তালাক প্রদান করে ছেলের অন্য জায়গায় বিয়ে দেবার জন্য। সেই অসহায় মেয়েটি যদি বাপের বাড়ি আসে, সমাজের ভয়ে তালাকের কথা বলতে চায় না, অযথা হয়রানি হবার ভয়ে। কেউ যদি  তাদের স্বামী কোথায় থাকেন জানতে চাইলে অনেক মেয়েই বলে, ‘ওরা বাইরে থাকে।‘ তালাকপ্রাপ্তা মেয়েদের তাদের পরিবার থেকে শিক্ষা দেওয়া হয় যেন তারা তাদের আত্মীয়দেরকে বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে অবিলম্বে না জানায়। কিন্তু তা এড়িয়ে যাওয়া এবং ভুল ধারণা দেওয়া সম্ভবত একমাত্র তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে বোঝে। কেন সে তার স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত  হয়ে বাঁচবে? বাপের বাড়িতে আলোচনা হলে, মেয়েটা একটু জোরে কথা বললে সবাই তাকে চুপ করে দেবে। পাছে পাশের বাড়ির লোকজন শুনতে পায়। তারা জানতে পারে মেয়েটি এখনও তার বাবার বাড়িতে থাকে। ভাবুন, জোরে কথা বলাটাও তার নিজের ঘরেই সমস্যা। এসবই শুধু তার মেয়ের ডিভোর্সের খবর আড়াল করার জন্য। ঘরে খোলামেলা কথা বলার অধিকারও হারায় মেয়েটি।

 

এমনকি একজন বিধবা অথবা ডিভোর্সি  মায়ের সন্তানকে  বাইরে দেখতে পেলেই সুযোগ বুঝে  পাড়ার লোকেরা বা আত্মীয় সজনরা প্রথমে বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় । বিধবা বা ডিভোর্সি নারীদের যদি কোনও পুরুষ বন্ধু বা সহকর্মী বাড়িতে আসে তবে এটি সমাজের চোখে আরও বিপজ্জনক। প্রতিবেশী যদি ছোট্ট শিশুটিকে ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করে? তোমার মায়ের সাথে যে পুরুষটিকে দেখলাম সেই লোকটা কে? তোমার মায়ের সাথে তার ক্যামন সম্পর্ক? সেই পুরুষটা কি হয় তোমার?  সেজন্য ছেলের বন্ধুর বাসায় না আসাই ভালো,  বিধবা নারীর পরিবারের বাকিরা ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দেয়। আবার অনেকে মেয়েটিকে ফোন করে আলাদা করে জিজ্ঞেস করে, “তোমার নতুন বাবা এসেছে?” সেই শিশুর ‘বাবা‘ সম্পর্কে জ্ঞান নেই। ‘বাবা‘ কী তাও সে জানে না। সে শুধু মায়ের কাছে থাকতে শিখেছে। সমাজ বা পরিবারকে বোঝাবে কে? বিধবা / ডিভোর্সি নারীদের সমাজের এই অনধিকার চর্চার প্রশ্নবাণে দুখের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় দিনের পর দিন।ডিভোর্সের কথা বলতেও একটা নির্দিষ্ট লজ্জা আছে।অনেকে মনে করেন তালাকপ্রাপ্তা মেয়েকে আত্মীয়ের বাড়িতে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। আমার আহাজারি যেমন সমাজ বোঝে না থিক তেমনই আমার এক হিন্দু বান্ধবীকে দেখেছি এই দুর্ভোগ সহ্য করতে। প্রশ্নের উত্তর দেবার লজ্জায় তাকে  বাড়িতে শঙ্খ ও সিঁদুর পরতে দেখেছি।

 

একজন সিঙ্গেল মা সিঁদুর ছাড়া রাস্তায় বের হলে মানুষ জিজ্ঞেস করে, “তুমি সিঁদুর পরো না কেন?” সে তার কপালের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার বর  কি অন্য কারো সাথে  আছে? নাকি ছেড়ে দিয়েছে তোমাকে ? ” সিঙ্গেল মাদার  ওয়েস্টার্ন কাপড় পরে অফিসে গেলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বাইরে কারো সাথে দেখা হলেই আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে  আপনি আদৌ অফিসে যাচ্ছেন কিনা নাকি কোন পুরুষের সাথে ডেট করতে যাচ্ছি কিনা। সেজে ঘর থেকে বের হলে পাড়ার এবং সমাজের লোকেরা বাজে কথা বলবে। বাড়ির লোকেরা আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে এমন সাজে ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।সিঙ্গেল মাদার শব্দটা শুনলে মানুষ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আপনার দিকে তাকায়। শুধুমাত্র বিধবা বা ডিভোর্সি  অবিবাহিত মায়েরা সেই চেহারার ভাষা দ্রুত বুঝতে পারে। কেউ কেউ সাহস করে উত্তর দেয়। কেউ কেউ উত্তর দিতে নারাজ। কারণ আমাদের সমাজে এখনো স্বামীর পরিচয়ে বসবাস করা খুবই সম্মানজনক বলেই মনে করে। স্বামী বেঁচে থাকুক না না থাকুক। এখনও বড়দের বলতে শুনি, পরিবারকে একসঙ্গে রাখার চেষ্টা করুন মা। স্বামী ও শ্বশুরবাড়িকে নিজের করে নিন। তারা যা বলে তা মেনে চলার চেষ্টা করুন। সমস্যা হল আমাদের সমাজে মেয়েদের যেভাবে শেখানো হয় এবং শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হয় সেভাবে ছেলেকে শেখানো হয় না।

 

বিধবা নারীদের অবস্থা তো আরও করুন। বাড়ির সকলের খাওয়া হয়ে গেলে যা বাঁচবে তাই খেতে হয়। আমিও খেয়েছি। এধরনের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মনের দিক থেকে অনেক নিচু মন মানসিকতার মানুষ হয়। শিক্ষিত হয়, কিন্তু সুশিক্ষিত হয় না।  কোনোদিন আলাদা করে আমার জন্য কিছু খাবার কাউকে তুলে রাখতে দেখি নাই। আমি খেলাম কি খেলাম না, আমার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান খাবার আছে কি না সেই খবরটুকু কেউ রাখে না। ভালো কিছু রান্না হলে আমার মেয়েটাকে খেতে দেই। তার জন্য অনেক কথা শুনতে হয় শ্বশুর বাড়ি। আমাকে বলে তোমার মেয়ে বড় হলে তো বিয়ে হয়ে যাবে। এখন থেকেই অল্প খাওয়াও। খাওয়ার লোভ বাড়িয়ে দিও না তাহলে শ্বশুর বাড়ি গেলে কম কম খাবে। আমার অতটুকু ছোটো বাচ্চা, যে এখনো স্কুল শেষ করল না, তার বিয়ের কথা চলছে। আমার মেয়েটাকে কম করে খেতে দিতে বলছে। ভাবতে পারছেন? শিক্ষিত হলেও সবাই সুশিক্ষিত বিবেবকবান নয়। আমাদের সমাজে  এখনও সিঙ্গেল বা বিধবা মায়েরদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি যেখানে আপনারা এই কষ্ট বুঝতে পারবেন।

12 Responses

  1. একদম সত্য কথা বলেছেন আপু।

  2. প্রশ্ন করবে না তো কি করবে?

  3. কিন্তু এই সিঙ্গেল ম্যাদাররাই যখন চুদিয়ে বেড়ায় তখন কি হয়? তাদের কোনও প্রশ্ন করা যাবেনা কেন?

  4. এটাই সমাজের বাস্তবতা

  5. কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন আপনি।

  6. ভালো কিছু নিয়ে লিখেন।

  7. হায় রে সমাজ!

  8. কি সব বিষয় নিয়ে লিখেন!

  9. খুব ভালো লিখেন আপনি। চালিয়ে যান।

  10. বিয়ে করে ফেললেই তো আর সিঙ্গেল থাকতে হয় না।

  11. আপনার লেখা পড়লে মন ভালো হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *